Friday, June 16, 2023

বাবাদের ঘরে ফেরা

সূর্যের শেষ আলোয় হাতঘড়িতে চোখ রেখে দেখি,
ঘণ্টা আর মিনিটের কাটা মুখ ঘুরিয়ে অভিমান করেছে।
পশ্চিম আকাশের শীতল লাল আলো,
কমিয়ে দিচ্ছে এই শহরের ক্লান্ত উত্তাপ।
অফিসের পাশে এই ছোট্ট টং-য়ে
রোজ এক কাপ চা হাতে নিয়ে ভাবতে থাকি,
আমার ছেলের জন্য আমি কতখানি বদলেছি।
দুই বছর আগে এই টং-য়ের সামনে দাঁড়ালেই,
আজিজ মামা একটা সিগারেট এগিয়ে দিতেন।
অফিস শেষে ঘরে ফিরে; মুহীবের গালে চুমো দিতে গেলে–
ওর মা ধমকাতো বলে ছেড়ে দিয়েছি।
অফিস শেষে আড্ডা দিয়ে বাসায় ফিরতে ফিরতে
মুহীব ঘুমিয়ে যায় বলে; আড্ডা দেওয়া কমিয়েছি।
এইসব ভাবতে ভাবতে আমি অনুভব করি,
ছোট বেলায় এক ঝুম বৃষ্টির রাতে, কেন —
আমার বাবা বাড়ি ফিরেছিলো ঠিক ন’টা বাজার আগেই।

একদিন আমি বাবার জন্য ভাত নিয়ে গেলাম নদীর ওপার।
পাটের আঁটির উপর বসে বাবা আর আমি ভাত খাচ্ছিলাম।
সাদা ভাতের উপর সাজিয়ে রাখা পাটশাক,
সরিষার তেলে ভাজা কালো শুকনো মরিচ আর লবণের উপর—
খইয়ের মতো ফুটতে শুরু করলো বৃষ্টির তীক্ষ্ণ জল।
তার উপর ডাল ঢেলে দিতেই স্নিগ্ধ আনন্দে মন ভরে যায়।
পাটের আঁটিগুলো চালার মতো বেঁধে ভেলা বানিয়ে,
বৃষ্টির ভেতর নদী পার হচ্ছিলাম দুজন।
এখন আমি টের পাই, পাটের ভেলায় বসে–
লগিতে ধাক্কা দিতে দিতে; কেন আমার বাবা
আমার চোখে চেয়ে হুট করে হেসে উঠেছিলো।

প্রায় বৃহস্পতিবারের রাতে আমার,
ঘরে ফিরতে ফিরতে মাঝরাত হয়ে যায়।
তবুও দেখি মুহীব ঘুমোয়নি।
আমার উপর অভিমান করে জেগে থাকে;
অথচ আমি যাওয়া মাত্রই গলা ঝড়িয়ে লাফিয়ে উঠে।
তারপর ওর মা'র ব্যস্ত কণ্ঠে শুনতে হয়—
সেই ঘুম জাগা অভিমানের ইতিহাস।
মুহীব ঘুমিয়ে যাওয়ার পর আনমনে ভেসে উঠে,
আমার বাবা মায়ের প্রেমে আমি কেমন ফুল হয়ে জন্মেছিলাম।

ঘাম আর বৃষ্টির এক হয়ে যাওয়া বাবার সেই ধূসর শার্টে,
ঘন কালো দাগ ঢাকা পরতো কাদামাটির স্তরে স্তরে।
আমার বাবার গরীব হওয়ার দুঃখটা টের পাই তখন,
যখন মাসের শেষে মুহীবের অসুখ হয়।
ডাক্তারের লেখা প্রেসক্রিপশনের সবগুলো ঔষধ,
ফলমূল আর নানান রকম খেলনা কেনার পরেও
একজোড়া বেলিফুল আমি ঠিকই কিনতে পারি। 
নিজেকে কতটা গুছিয়ে নিয়েছি; তার একমাত্র সাক্ষী–
চার বছর আগে নতুন বউয়ের দেওয়া এই চামড়ার মানিব্যাগ।
বাবাদের বুঝি গুছিয়েই চলয়ে হয়;
যেভাবে গুছিয়ে চলে মায়ের রান্নাঘর।

গতবার যখন গ্রামে গিয়েছিলাম; আমার বাবা তখন–
মুহীবকে কোলে নিয়ে ডাক শিখাচ্ছিলেন “দা-দা দা-দা”।
বাবা রোজ সন্ধ্যায় ঘরে ফেরার সময়,
মুহীবের জন্য কিছু না কিছু নিয়েই আসতেন।
একদিন মা ওর দাদার কাছে নিয়ে যাওয়ার ছলে
মুহীবের আঙুল ধরে হাঁটতে শিখাচ্ছিলো।
আমি তখন সুখের ঘোরে খুব গোপনে
মুহীবের মায়ের চোখে চেয়ে নিঃশব্দে হেঁসে দিলাম।
সেই হাসি দেখলো না কেউ; জানলো না কেউ।

বাবা প্রায়ই শীতের সকালে প্রথম আলোয়,
মুহীবকে নিয়ে যেতো মসজিদের পাশের কবরস্থানে।
আগামী শীতে বাবা নিশ্চয় মুহীবকে
তার পূর্বপুরুষের কবর চেনাতে পারবে।
ততদিনে মুহীব কথা বলতে শিখে যাবে;
ইতিহাস তখন দাদা-নাতীর গল্প হয়ে যাবে।
কিংবা কেমন হবে! – যদি সেখানে,
গড়ে উঠে আরো একটি নতুন কবর?

এইসব ভাবতে ভাবতে চা ফুরিয়ে যায়।
আমি হাঁটতে থাকি; — একটুখানি আগে ঘরে ফিরতে
লোকাল বাস ছেড়ে সিএনজি’র দর কষাকষি করি।
পূর্ণিমার রাতে বেলি ফুলের মালা কিনতে গেলে,
মুহীবের জন্যও একটি কিনতে হয়; নয়তো–
হাসিমুখে ফুল তার মালিক বদলে ফেলে।
এমন একেকটি বেলিফুলের মালা কেনার জন্য,
আমি সারাটা বিকেল অবসাদ নিয়ে অপেক্ষা করতে পারি।
তারপর, তারপর আমার ঘরে ফেরা ক্লান্ত বুকে
লাফিয়ে উঠা ছেলের হাসিমুখ; আর সেই মুখে
উচ্চারিত সেই পুরোনো শব্দ “বাব-বা"—
আমার সকল অবসাদ নিমিষেই হারিয়ে যায়।
নিজেকে তখন বাবার মতো নায়ক মনে হয়।

No comments:

Post a Comment

অন্ধের অন্ধকার

বিষাদ দিনযাপনের ইতিহাস থাকুক শহর জুড়ে। ঘর থেকে বের হলেই যেন দেখতে পাই, নষ্ট হওয়া খাবারের গন্ধে কতটা উন্মাদ দাঁড় কাক। ঘৃণাভরা কোলাহল ভাঙলেই য...