Friday, May 27, 2022

আমি যেইখানে জন্মাইছিলাম

 আমি যেইখানে জন্মাইছিলাম, সেইখানে ভোর হইলে মোরগ ডাকতো। গাছের ডালে দল বাইন্ধা পাখিরা কিচিরমিচির করতো। উঠোন ঝাড়ু দেওয়ার আগে সেইখানে আমার পায়ের ছাপ পরতো। মাঠের ঘাসে জইমা থাকা শিশিরে আমার পা দুইখান গোসল করতো। দুই হাত দিয়া তুইলা নেওয়া শিশির দিয়া মুখ ধুইলে আমার পরাণ জুড়াইতো। বকুলতলায় তাজা বকুলের ঘ্রাণ পাওয়া যাইতো। ঘরের দেয়ালে সেই বকুল মালা হইয়া ঝুইলা থাকতো। শীতের দিনে ভাতভাজি আর গরমের দিনের পান্তাভাত আমারে তৃপ্তি দিতো। আমার মায় চুলায় ভাত উঠানোর পর, উঠোনের পাশের আম গাছটাতে ইষ্টিকুটুম গান গাইতো।

আমি যেইখানে জন্মাইছিলাম, সেইখানে লোডশেডিং ছিলো। ভরদুপুরে পুকুরপাড়ে দক্ষিণা বাতাস আইতো। ফ্রিজ না থাকলেও, নানানরকম গাছের টাটকা ফল ছিলো। দল বাইন্ধা ছুটাছুটি করার মত পোলাইপান ছিলো। লাফালাফি করার মতো নদী ছিলো, পুকুর ছিলো।

আমি যেইখানে জন্মাইছিলাম, সেইখানে বিকেল হইলে দল বাইন্ধা মাঠে খেলা হইতো। কানামাছি, গোল্লাছুট, হাডুডু, জুতাচুর, চোর-পুলিশ থেইকা শুরু কইরা ক্রিকেট, ফুটবল, লুডু; নানান রকম খেলা। শিশু-কিশোরের শরীরে বিকেলের ধুলো জমতো, মায়ের বকুনি শুনতো, মাইর খাইতো। শেষমেশ মাগরিবের আজানে ঘরে ফিরতো। হারিকেন জ্বালায়া পড়তে বসতো।

আমি যেইখানে জন্মাইছিলাম, সেইখানে দিনের বেলায় ফড়িং উড়তো। আর রাইতে জোনাক পোকার আলো জ্বলতো। সেই আলো মশারীর ভিতর পোষ মানতো। রাতের অন্ধকারে গাছের শীতল বাতাস বইতো। সেই বাতাসে ছোট বড় সবাই গল্প করতো। হাত পাখায় নানান রকম দৃশ্য ছিলো। সেই দৃশ্য ধীরে ধীরে দুলতো। ঘুমের সময় টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ ছিলো।

অথচ আমরা সভ্যতা আর আধুনিকতার লোভে পইরা আমাদের জন্মের স্থান বেইচা দিছি একদল কষাইয়ের কাছে। কষাইয়েরা হাজার বোল্ডের ইলেকট্রিসিটি দিয়া আমার ছেলেবেলার জোনাকপোকাদের মাইরা ফালাইছে। আমাদের হাত থেইকা কাইড়া নিছে হাতপাখা। একটা স্মার্টফোন দিয়া জবাই করছে আমাদের ছেলেবেলা। "পড়ালেখা" নামের হাতুড়ি দিয়া পিষাইয়া ফেলছে আমাদের ছেলেমানুষী আত্মা। এইসবের পর, আমি যেইখানে জন্মাইছিলাম, সেইখানে কেউ কোনো শিশুরে জন্ম দিতে পারবো?

কৃত্রিম মৃত্যু

পৃথিবীতে জন্মানোর দোষে,
যাবত জীবন কারাদণ্ড নিয়া পইরা আছি সংসারে।
মুক্তির জন্য প্রয়োজন মৃত্যু। কিংবা,
সংসার থাইকা আমৃত্যু পালায়া থাকা।

সংসারে গেলো বাইশটা বছর।
শিকড়ও তাই কম ছড়ায় নাই,
উপড়ায়া তুলতেও কলিজায় লাগে।
লাগে লাগুক, মৃত্যুতেও তো লাগে।

সব কিছু ছাইড়া ছুইড়া যাইবার আগে
কদম পাতায় ছাড়পত্র লিখলাম, "কৃত্রিম মৃত্যু"।
সংসারের মায়া শালার পৃথিবীর সমান;
তাইতো চিড়িয়া, সংসার কারাগারে যাবত জীবন ভোগে।

সংসার ছাড়লাম আষ্ট দিন হইলো,
ছিলাম বন্ধুদের ঠিকানায়, ঐটাও ছাড়লাম।
এখন আমি পরিপূর্ণ একা, নিঃসঙ্গ -উলঙ্গ গাছের মতো।
গাছের শরীরেও কি বীজের মায়া জাইগা থাকে?

সারাদিন পার্কে ঘুরলাম, পুরানা সব দৃশ্য দেখলাম।
পুরানা সব দৃশ্যের নতুন অর্থ খুঁইজা পাইলাম।
হকারের পণ্য আর শিশুদের ফুল বিক্রি এইবার
বেঞ্চে পইরা থাকা প্রেমের চেয়ে অর্থপূর্ণ লাগলো।

জীবনরে চাষাবাদ না কইরা, চাষাবাদ করি প্রেম।
প্রেম খুঁজি প্রেমিকার চোখে-ঠোঁটে-চূম্মনে,
প্রেম খুঁজি গোলাপের রঙে, কিংবা প্রেমিকের ঘামে।
অথচ প্রেম পইরা থাকে পৃথিবীর সমগ্র বিচ্ছেদে।

বেঞ্চে শুইয়া পাতাদের দুলনিতে আকাশ দেইখা ভাবি,
সংসারী না হইলে, কর্ম-হতাশার গল্প তৈরি হয় না।
বাঁইচা থাকার লাইগা, শুধু পৃথিবীটাই সংসার;
সুখে থাকার লাইগা, দুই বেলা ভাত জুটানোই কর্ম।

তারপর সন্ধ্যা নামে, ল্যাম্পপোস্টে প্রাণ আসে।
তখন পুলিশ ডাইকা কয়, "চইলা যান ভাই"।
কই যাইবো! আমার তো কোনো ঠিকানা নাই।
ঠিকানা বানাইলেই সংসার হইয়া যায়। 

Sunday, May 22, 2022

প্রত্যাবর্তন

 আমার পিছনে বিশাল বড় বালুচর। বালুচরের পরে গহীন অরণ্য। বড় বড় সবুজ গাছ ছাড়া আর কিচ্ছু দেখা যায় না। শু শু কইরা বাতাসের সাথে উইড়া আসে নানান রকম পাখির আওয়াজ। বাতাসের বেগে মাঝেমধ্যে সাদা বালুগুলা ছুটাছুটি করে।

আমার সামনে চিৎ হইয়া পইরা আছে সতেরো বছর বয়সী কোন সুদর্শনা তরুণীর মতো সুন্দর এক নদী। নয়া যৌবনের মতো নিরব ঢেউ নদীর সারা শরীরে বইয়া যাইতেছে। তার উপ্রে দিয়া ভাইসা যাইতেছে সবুজ কচুরিপানা; যেমন ভাইসা থাকে তরুণীর ঠোঁটের কোণে একটা তিল। বিশাল প্রস্থ নিয়া পইরা থাকা এই নদীর ঐপাশে ইয়া বড় খোলা মাঠ। যেন মাঠের পরে আসমান-জমিনের মিলন ছাড়া আর কিচ্ছু নাই।

আমি নদীতে পা চুবাইয়া বালুর উপ্রে বইসা আছি। পা দুইটা নাড়াইয়া পানির মধ্যে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ তুলতেছি। ছোট ছোট ঢেউ আইসা আমার হাঁটু পর্যন্ত ভিজাইয়া যায়। আমি উদাসীন চোক্ষে আসমানে তাকাই, মাথা নামাইয়া নদীরে দেখি, চোখ দুইটা ছাইড়া দিয়া জমিনের শেষ সীমানা খুঁজি। হুট কইরা নদীতে ঠোঁট লাগাইয়া মাছ ধইরা নিয়া যাওয়া মাছরাঙার রঙ দেখি। পাখনা দুইটা মেইলা দিয়া উইড়া বেড়ানো চিল দেখি।

বালুচরের পিছনে যে গহীন অরণ্য, তার ঐপাশে নাগরিক জীবন। উন্নয়নশীল কোন দেশের মফস্বল নয়; টেমস নদীর পাশে বাইড়া উঠা লন্ডনের মতো কোন উচ্চবিলাসী শহর। রাস্তায় ট্রাফিক নাই, ট্রাফিকের ভিড়ে ফুল বিক্রি করা শিশুরা নাই, ফুটপাতে হকার বা মানুষের কোলাহল নাই। শুধু আছে বড় বড় দালান আর সারি সারি ল্যাম্পপোস্ট। এইরকম একটা দালানের মধ্যে আছে "taste your soul" নামের এক বিলাসী মদের বার।

গোধূলীর আলোয় আমি বালুচর ধরে হাঁটতে হাঁটতে অরণ্য ছাইড়া প্রবেশ করি সভ্যতার শহরে। বোহেমিয়ান পায়ে হাঁইটা হাঁইটা আমি পৌঁছে যাই সেই মদের বারে।

পুরো বার জুড়ে নানান রঙের বাতি। প্রতিটা টেবিলে রাখা আছে এস্ট্রে আর লাইটার। নিচু ভলিউমে বাজছে ক্লাসিক্যাল মিউজিক। মিউজিকের ব্যাকগ্রাউন্ডে মানুষের কথোপকথন। দেইখা মনে হইতেছে না এখানে একদল মাতাল নেষায় বোধ হইয়া আছে।

রোবটের মতো এক বারম্যান আইসা চকচকে গ্লাস, বরফ আর হুইস্কি রাইখা গেলো আমার টেবিলে। গ্লাসের ভিতর হুইস্কি ঢাইলা, দুই টুকরা বরফ ছাইড়া দিয়া আমি পেগ বানাইলাম। এক পেগ, দুই পেগ করতে করতে যখন আমি পুরো বোতল শেষ করলাম। তখন আমার মনে পড়লো, এই বারের নাম “taste your soul”। আমি তখন নিজেকে জানার জন্য বের হইয়া পড়লাম শহরের রাজপথে।

নিজের আত্মার সাথে কথা কইয়া আমি জানতে পারলাম, সে আসলে শহুরে জীবন চায় না। আমি তখন বেরিয়ে পড়লাম আমার পুরানা ঠিকানার খুঁজে। গহীন অরণ্যের পথ ধরে তরুণীর মতো চিরযৌবনা নদীর তীরে।

ফেরার পথে অরণ্যের গাছেরা আমারে জিজ্ঞেস করে, গাছের পাখিরা আমারে জিজ্ঞেস করে, বালুর উপর বইয়া যাওয়া বাতাস আমারে জিজ্ঞেস করে, নদীপাড় ধরে ছুটাছুটি করা মাছরাঙা আমারে জিজ্ঞেস করে, আমারে শান্তি দেওয়া নদী আমাকে জিজ্ঞেস করে- “কিসের লোভে কই গেছিলা? কিসের অভাবে আবার পালাইয়া আইলা?” আমি শুধু নির্বাক চোখে সব দেখতে থাকলাম। এই মুহুর্তে আমি নিজের আত্মা স্পর্শ করলাম।

Tuesday, May 10, 2022

আবার যদি পৃথিবীতে ফিরা আইতাম

এই জীবনের পরে যদি আরো একটা জীবন এই পৃথিবীতে পাইতাম, তাইলে অনেক দূরের কোনো গ্রামে ভিটা বানাইতাম। যেই গ্রামের পাশ দিয়া বইয়া গেছে ঢেউ ছাড়া কোনো নদি। যেই গ্রামের মধ্যে তালগাছের মতো খাড়ায়া আছে ছোট বড় পাহাড়। বৃষ্টির দিনে আমি দাঁত কাঁপাইতে কাঁপাইতে উইঠা যাইতাম সবচেয়ে বড় পাহাড়টার মাথায়। সেইখান থাইকা কান পাইতা শুনতাম, ঘর ভাইঙা যাওয়া পাখিদের কান্দোনের চিৎকার। এক দৃষ্টিতে তাকায়া দেখতাম, গাছের পাতার মধ্যে বৃষ্টির একফোটা পানি ঝুইলা থাকতে চাইয়াও কেম্নে হুট কইরা পইরা যায়। তারপর পিছলায়া পিছলায়া পাহাড় থাইকা নামতে নামতে নদিতে যাইতাম। নদির মধ্যে ডুব দিয়া শুনতাম, খই ভাজনের মতো বৃষ্টির ফোটার শব্দ। নদির মইধ্যে গা ভাসাইয়া আসমানের দিকে তাকাইয়া দেখতাম, বৃষ্টির ফোটারা কেমন দল বাইন্ধা নাইমা আসে।

ঘুটঘুটে আন্ধার রাইতে খোলা মাঠে যাইতাম। যেইখানে বিলের পানিতে ভাইসা থাকা পদ্মফুল, আঁকাবাঁকা রাস্তার কিনারা ঘেইষা নানান রকম ঘাসের পাশ দিয়া দোলতে থাকা কাঁশফুল আর ইয়া বড় সবুজ ঘাসের মাঠের সব সৌন্দর্য ডাইকা যায় আন্ধারের পর্দায়। সেইখান থাইকা জোঁনাকপোকার রঙিন আলোর খেলা দেখতাম। পাখির কিচির-মিচির আর বাতাসের শু-শু আওয়াজ এক হইয়া আন্ধারের মইধ্যে একটা ঢেউ তুলতো। যেই ঢেউয়ের ধাক্কায় আমি ঘোরের মধ্যে পইরা যাইতাম। তারপর উপরের দিক তাকাইয়া দেখতাম, আসমানের রঙটাও পিচাশের মতো কালা; জোঁনাকপোকার মতো জ্বলতে থাকা তারাগুলা শুধু এইটা বুঝতে দিতো না। 

আর ভরা জ্যোৎস্নার রাইতে নদির মাঝখানে যাইয়া ছোট্ট একটা নৌকার উপর চিৎ হইয়া শুইয়া থাকতাম। আর ভাবতাম, নদিটার কি আজীবন এইভাবে চিৎ হইয়া শুইয়া থাকতে বিরক্ত লাগে না? সারাটা জীবন উপর দিয়া সাদা মেঘরে উড়তে দেইখা নদিটার কি ইচ্ছা করে না একটুখানি উড়াল দিতে? নৌকায় দোলতে দোলতে আরো অনেক কিছু ভাবতাম। ভাবতে ভাবতে মনের সুখে জ্যোৎস্নার দিকে দুই একটা কথা ছুইড়া দিতাম। জ্যোৎস্না তখন লজ্জা পাইয়া মেঘের আড়ালে লোকায়া যাইতো। আর আমি সেই আন্ধারে ধীরে ধীরে ঘুমায়া যাইতাম। শুধু কানের মধ্যে বাজতে থাকতো নৌকা আর পানির ধাক্কার চিকন চিকন শব্দ; ঘুমের ঘোরে আমার তখন মনে হইবো, বেহেস্ত থাইকা কোনো হূর নুপুর পায়ে পানির উপর দিয়া হাঁইটা হাঁইটা আমার দিকে আইতাছে।

আমি যদি মরণের পর আরেকবার পৃথিবীতে ফিরা আইতাম, তাইলে মানুষ থাইকা অনেক দূরে পালায়া যাইতাম। যতদূর পালায়া গেলে নিজের সুখ মাপার লাইগা অন্যের সুখের দিকে তাকাইতে হইতো না। যতদূর পালায়া গেলে অর্থের কাছে নিজেরে বেইচা দেওয়া লাগতো না। যতদূর পালায়া গেলে ইস্কুলের রোল নম্বর আমারে আলাদা করতো না। ততদূর যাইয়া, ঠিক ততদূর যাইয়া চিৎকার কইরা পৃথিবীরে জিগাইতাম, "কে কারে ভালোবাসে? কে নিজেরে ভালোবাসে?"। আমি জানি, পৃথিবী বৃষ্টি নামায়া কানতো, আর বর্জপাতের মতো চিৎকার কইরা কইতো, "কেউ কাউরে ভালোবাসে না, কেউ নিজেরে ভালোবাসে না"।

অন্ধের অন্ধকার

বিষাদ দিনযাপনের ইতিহাস থাকুক শহর জুড়ে। ঘর থেকে বের হলেই যেন দেখতে পাই, নষ্ট হওয়া খাবারের গন্ধে কতটা উন্মাদ দাঁড় কাক। ঘৃণাভরা কোলাহল ভাঙলেই য...