Sunday, May 22, 2022

প্রত্যাবর্তন

 আমার পিছনে বিশাল বড় বালুচর। বালুচরের পরে গহীন অরণ্য। বড় বড় সবুজ গাছ ছাড়া আর কিচ্ছু দেখা যায় না। শু শু কইরা বাতাসের সাথে উইড়া আসে নানান রকম পাখির আওয়াজ। বাতাসের বেগে মাঝেমধ্যে সাদা বালুগুলা ছুটাছুটি করে।

আমার সামনে চিৎ হইয়া পইরা আছে সতেরো বছর বয়সী কোন সুদর্শনা তরুণীর মতো সুন্দর এক নদী। নয়া যৌবনের মতো নিরব ঢেউ নদীর সারা শরীরে বইয়া যাইতেছে। তার উপ্রে দিয়া ভাইসা যাইতেছে সবুজ কচুরিপানা; যেমন ভাইসা থাকে তরুণীর ঠোঁটের কোণে একটা তিল। বিশাল প্রস্থ নিয়া পইরা থাকা এই নদীর ঐপাশে ইয়া বড় খোলা মাঠ। যেন মাঠের পরে আসমান-জমিনের মিলন ছাড়া আর কিচ্ছু নাই।

আমি নদীতে পা চুবাইয়া বালুর উপ্রে বইসা আছি। পা দুইটা নাড়াইয়া পানির মধ্যে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ তুলতেছি। ছোট ছোট ঢেউ আইসা আমার হাঁটু পর্যন্ত ভিজাইয়া যায়। আমি উদাসীন চোক্ষে আসমানে তাকাই, মাথা নামাইয়া নদীরে দেখি, চোখ দুইটা ছাইড়া দিয়া জমিনের শেষ সীমানা খুঁজি। হুট কইরা নদীতে ঠোঁট লাগাইয়া মাছ ধইরা নিয়া যাওয়া মাছরাঙার রঙ দেখি। পাখনা দুইটা মেইলা দিয়া উইড়া বেড়ানো চিল দেখি।

বালুচরের পিছনে যে গহীন অরণ্য, তার ঐপাশে নাগরিক জীবন। উন্নয়নশীল কোন দেশের মফস্বল নয়; টেমস নদীর পাশে বাইড়া উঠা লন্ডনের মতো কোন উচ্চবিলাসী শহর। রাস্তায় ট্রাফিক নাই, ট্রাফিকের ভিড়ে ফুল বিক্রি করা শিশুরা নাই, ফুটপাতে হকার বা মানুষের কোলাহল নাই। শুধু আছে বড় বড় দালান আর সারি সারি ল্যাম্পপোস্ট। এইরকম একটা দালানের মধ্যে আছে "taste your soul" নামের এক বিলাসী মদের বার।

গোধূলীর আলোয় আমি বালুচর ধরে হাঁটতে হাঁটতে অরণ্য ছাইড়া প্রবেশ করি সভ্যতার শহরে। বোহেমিয়ান পায়ে হাঁইটা হাঁইটা আমি পৌঁছে যাই সেই মদের বারে।

পুরো বার জুড়ে নানান রঙের বাতি। প্রতিটা টেবিলে রাখা আছে এস্ট্রে আর লাইটার। নিচু ভলিউমে বাজছে ক্লাসিক্যাল মিউজিক। মিউজিকের ব্যাকগ্রাউন্ডে মানুষের কথোপকথন। দেইখা মনে হইতেছে না এখানে একদল মাতাল নেষায় বোধ হইয়া আছে।

রোবটের মতো এক বারম্যান আইসা চকচকে গ্লাস, বরফ আর হুইস্কি রাইখা গেলো আমার টেবিলে। গ্লাসের ভিতর হুইস্কি ঢাইলা, দুই টুকরা বরফ ছাইড়া দিয়া আমি পেগ বানাইলাম। এক পেগ, দুই পেগ করতে করতে যখন আমি পুরো বোতল শেষ করলাম। তখন আমার মনে পড়লো, এই বারের নাম “taste your soul”। আমি তখন নিজেকে জানার জন্য বের হইয়া পড়লাম শহরের রাজপথে।

নিজের আত্মার সাথে কথা কইয়া আমি জানতে পারলাম, সে আসলে শহুরে জীবন চায় না। আমি তখন বেরিয়ে পড়লাম আমার পুরানা ঠিকানার খুঁজে। গহীন অরণ্যের পথ ধরে তরুণীর মতো চিরযৌবনা নদীর তীরে।

ফেরার পথে অরণ্যের গাছেরা আমারে জিজ্ঞেস করে, গাছের পাখিরা আমারে জিজ্ঞেস করে, বালুর উপর বইয়া যাওয়া বাতাস আমারে জিজ্ঞেস করে, নদীপাড় ধরে ছুটাছুটি করা মাছরাঙা আমারে জিজ্ঞেস করে, আমারে শান্তি দেওয়া নদী আমাকে জিজ্ঞেস করে- “কিসের লোভে কই গেছিলা? কিসের অভাবে আবার পালাইয়া আইলা?” আমি শুধু নির্বাক চোখে সব দেখতে থাকলাম। এই মুহুর্তে আমি নিজের আত্মা স্পর্শ করলাম।

No comments:

Post a Comment

অন্ধের অন্ধকার

বিষাদ দিনযাপনের ইতিহাস থাকুক শহর জুড়ে। ঘর থেকে বের হলেই যেন দেখতে পাই, নষ্ট হওয়া খাবারের গন্ধে কতটা উন্মাদ দাঁড় কাক। ঘৃণাভরা কোলাহল ভাঙলেই য...