আমি যেইখানে জন্মাইছিলাম, সেইখানে ভোর হইলে মোরগ ডাকতো। গাছের ডালে দল বাইন্ধা পাখিরা কিচিরমিচির করতো। উঠোন ঝাড়ু দেওয়ার আগে সেইখানে আমার পায়ের ছাপ পরতো। মাঠের ঘাসে জইমা থাকা শিশিরে আমার পা দুইখান গোসল করতো। দুই হাত দিয়া তুইলা নেওয়া শিশির দিয়া মুখ ধুইলে আমার পরাণ জুড়াইতো। বকুলতলায় তাজা বকুলের ঘ্রাণ পাওয়া যাইতো। ঘরের দেয়ালে সেই বকুল মালা হইয়া ঝুইলা থাকতো। শীতের দিনে ভাতভাজি আর গরমের দিনের পান্তাভাত আমারে তৃপ্তি দিতো। আমার মায় চুলায় ভাত উঠানোর পর, উঠোনের পাশের আম গাছটাতে ইষ্টিকুটুম গান গাইতো।
আমি যেইখানে জন্মাইছিলাম, সেইখানে লোডশেডিং ছিলো। ভরদুপুরে পুকুরপাড়ে দক্ষিণা বাতাস আইতো। ফ্রিজ না থাকলেও, নানানরকম গাছের টাটকা ফল ছিলো। দল বাইন্ধা ছুটাছুটি করার মত পোলাইপান ছিলো। লাফালাফি করার মতো নদী ছিলো, পুকুর ছিলো।আমি যেইখানে জন্মাইছিলাম, সেইখানে বিকেল হইলে দল বাইন্ধা মাঠে খেলা হইতো। কানামাছি, গোল্লাছুট, হাডুডু, জুতাচুর, চোর-পুলিশ থেইকা শুরু কইরা ক্রিকেট, ফুটবল, লুডু; নানান রকম খেলা। শিশু-কিশোরের শরীরে বিকেলের ধুলো জমতো, মায়ের বকুনি শুনতো, মাইর খাইতো। শেষমেশ মাগরিবের আজানে ঘরে ফিরতো। হারিকেন জ্বালায়া পড়তে বসতো।
আমি যেইখানে জন্মাইছিলাম, সেইখানে দিনের বেলায় ফড়িং উড়তো। আর রাইতে জোনাক পোকার আলো জ্বলতো। সেই আলো মশারীর ভিতর পোষ মানতো। রাতের অন্ধকারে গাছের শীতল বাতাস বইতো। সেই বাতাসে ছোট বড় সবাই গল্প করতো। হাত পাখায় নানান রকম দৃশ্য ছিলো। সেই দৃশ্য ধীরে ধীরে দুলতো। ঘুমের সময় টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ ছিলো।
অথচ আমরা সভ্যতা আর আধুনিকতার লোভে পইরা আমাদের জন্মের স্থান বেইচা দিছি একদল কষাইয়ের কাছে। কষাইয়েরা হাজার বোল্ডের ইলেকট্রিসিটি দিয়া আমার ছেলেবেলার জোনাকপোকাদের মাইরা ফালাইছে। আমাদের হাত থেইকা কাইড়া নিছে হাতপাখা। একটা স্মার্টফোন দিয়া জবাই করছে আমাদের ছেলেবেলা। "পড়ালেখা" নামের হাতুড়ি দিয়া পিষাইয়া ফেলছে আমাদের ছেলেমানুষী আত্মা। এইসবের পর, আমি যেইখানে জন্মাইছিলাম, সেইখানে কেউ কোনো শিশুরে জন্ম দিতে পারবো?
No comments:
Post a Comment