এই জীবনের পরে যদি আরো একটা জীবন এই পৃথিবীতে পাইতাম, তাইলে অনেক দূরের কোনো গ্রামে ভিটা বানাইতাম। যেই গ্রামের পাশ দিয়া বইয়া গেছে ঢেউ ছাড়া কোনো নদি। যেই গ্রামের মধ্যে তালগাছের মতো খাড়ায়া আছে ছোট বড় পাহাড়। বৃষ্টির দিনে আমি দাঁত কাঁপাইতে কাঁপাইতে উইঠা যাইতাম সবচেয়ে বড় পাহাড়টার মাথায়। সেইখান থাইকা কান পাইতা শুনতাম, ঘর ভাইঙা যাওয়া পাখিদের কান্দোনের চিৎকার। এক দৃষ্টিতে তাকায়া দেখতাম, গাছের পাতার মধ্যে বৃষ্টির একফোটা পানি ঝুইলা থাকতে চাইয়াও কেম্নে হুট কইরা পইরা যায়। তারপর পিছলায়া পিছলায়া পাহাড় থাইকা নামতে নামতে নদিতে যাইতাম। নদির মধ্যে ডুব দিয়া শুনতাম, খই ভাজনের মতো বৃষ্টির ফোটার শব্দ। নদির মইধ্যে গা ভাসাইয়া আসমানের দিকে তাকাইয়া দেখতাম, বৃষ্টির ফোটারা কেমন দল বাইন্ধা নাইমা আসে।
ঘুটঘুটে আন্ধার রাইতে খোলা মাঠে যাইতাম। যেইখানে বিলের পানিতে ভাইসা থাকা পদ্মফুল, আঁকাবাঁকা রাস্তার কিনারা ঘেইষা নানান রকম ঘাসের পাশ দিয়া দোলতে থাকা কাঁশফুল আর ইয়া বড় সবুজ ঘাসের মাঠের সব সৌন্দর্য ডাইকা যায় আন্ধারের পর্দায়। সেইখান থাইকা জোঁনাকপোকার রঙিন আলোর খেলা দেখতাম। পাখির কিচির-মিচির আর বাতাসের শু-শু আওয়াজ এক হইয়া আন্ধারের মইধ্যে একটা ঢেউ তুলতো। যেই ঢেউয়ের ধাক্কায় আমি ঘোরের মধ্যে পইরা যাইতাম। তারপর উপরের দিক তাকাইয়া দেখতাম, আসমানের রঙটাও পিচাশের মতো কালা; জোঁনাকপোকার মতো জ্বলতে থাকা তারাগুলা শুধু এইটা বুঝতে দিতো না।
আর ভরা জ্যোৎস্নার রাইতে নদির মাঝখানে যাইয়া ছোট্ট একটা নৌকার উপর চিৎ হইয়া শুইয়া থাকতাম। আর ভাবতাম, নদিটার কি আজীবন এইভাবে চিৎ হইয়া শুইয়া থাকতে বিরক্ত লাগে না? সারাটা জীবন উপর দিয়া সাদা মেঘরে উড়তে দেইখা নদিটার কি ইচ্ছা করে না একটুখানি উড়াল দিতে? নৌকায় দোলতে দোলতে আরো অনেক কিছু ভাবতাম। ভাবতে ভাবতে মনের সুখে জ্যোৎস্নার দিকে দুই একটা কথা ছুইড়া দিতাম। জ্যোৎস্না তখন লজ্জা পাইয়া মেঘের আড়ালে লোকায়া যাইতো। আর আমি সেই আন্ধারে ধীরে ধীরে ঘুমায়া যাইতাম। শুধু কানের মধ্যে বাজতে থাকতো নৌকা আর পানির ধাক্কার চিকন চিকন শব্দ; ঘুমের ঘোরে আমার তখন মনে হইবো, বেহেস্ত থাইকা কোনো হূর নুপুর পায়ে পানির উপর দিয়া হাঁইটা হাঁইটা আমার দিকে আইতাছে।
আমি যদি মরণের পর আরেকবার পৃথিবীতে ফিরা আইতাম, তাইলে মানুষ থাইকা অনেক দূরে পালায়া যাইতাম। যতদূর পালায়া গেলে নিজের সুখ মাপার লাইগা অন্যের সুখের দিকে তাকাইতে হইতো না। যতদূর পালায়া গেলে অর্থের কাছে নিজেরে বেইচা দেওয়া লাগতো না। যতদূর পালায়া গেলে ইস্কুলের রোল নম্বর আমারে আলাদা করতো না। ততদূর যাইয়া, ঠিক ততদূর যাইয়া চিৎকার কইরা পৃথিবীরে জিগাইতাম, "কে কারে ভালোবাসে? কে নিজেরে ভালোবাসে?"। আমি জানি, পৃথিবী বৃষ্টি নামায়া কানতো, আর বর্জপাতের মতো চিৎকার কইরা কইতো, "কেউ কাউরে ভালোবাসে না, কেউ নিজেরে ভালোবাসে না"।
No comments:
Post a Comment